এম জহিরুল ইসলাম : পরিবারের মূলভিত্তি হলো বিয়ে। বিয়ের মাধ্যমেই গড়ে উঠে পরিবার, রচিত হয় সভ্যতার ভিত্তিভূমি। তাই পরিবার গঠনে উদ্বুদ্ধ করতে বিয়ের নির্দেশ প্রদান করেছে ইসলাম। মহান আল্লাহ বলেন ‘বিয়ে করবে নারীদের মধ্য থেকে যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই, তিন অথবা চার; আর যদি আশঙ্কা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে।’ (সুরা আননিসা-৩)।
মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কারণ তা দৃষ্টিকে সংবরণকারী এবং লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণকারী। বিয়ে ইসলামে এক অনন্য ব্যবস্থা। এর তাৎপর্য ও উপকারিতা অপরিসীম। নিচে এ সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা করা হলো।
এক. আল্লাহতায়ালা মানুষকে সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ তার প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের জন্য সদা উদগ্রীব থাকে। যদি সে তার মনোদৈহিক চাহিদা পূরণের অবকাশ না পায়, তাহলে হতচকিত-বিচলিত হয়ে পড়ে এবং পাপের পথে ধাবমান হয়। এক্ষেত্রে বিয়েই একমাত্র কার্যকর ব্যবস্থা, যা তার দেহ-মনের চাহিদা পূরণ করে। তাকে আত্মিক প্রশান্তি ও অনাবিল সুখানুভূতিতে অবগাহন করিয়ে ব্যভিচারের পথ থেকে নিবৃত্ত করে।
এদিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর (আল্লাহ) নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গীনিদেরকে, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সমপ্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা আ রূম-২১)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘স্ত্রীলোক শয়তানের বেশে সামনে আসে এবং শয়তানের বেশে প্রস্থান করে। অতএব তোমাদের কেউ কোনো স্ত্রীলোক দেখতে পেলে সে যেন তার স্ত্রীর নিকট আসে। কারণ তা তার মনের ভেতর যা রয়েছে তা দূর করে দেবে।’
দুই. সন্তান জন্মদান ও বংশবিস্তার বিয়ের অন্যতম একটি উদ্দেশ্যে। বিয়ের মাধ্যমে এক পরিবারের সঙ্গে আরেক পরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে। অতঃপর তিনি তার বংশগত ও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন।’ (সুরা আল ফুরকান-৫৪)।
তিন, দৃষ্টি সংযতকরণ, আদর্শ জাতি ও আদর্শ সমাজ গঠন এবং পৃথিবী আবাদ করার জন্য বিয়ের প্রয়োজন।
চার. বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য লাভ করা যায় ও আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়। আল্লাহরাববুল আলামীন ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করো এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আননূর-৩২)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির সাহায্য করা আল্লাহর কর্তব্য হয়ে পড়ে।
তারা হলো- ক. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী। খ. যে দাস নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে চায়। ৩. যে লোক বিয়ে করে চারিত্রিক নিষ্কলুষতা রক্ষা করতে চায়।’
পাঁচ, বিয়ের মাধ্যমে চারিত্রিক অবক্ষয় থেকে জাতি রক্ষা পায়। সমাজে যেনা-ব্যভিচার ও অশ্লীলতা হ্রাস পায়।
স্বামীর দায়িত্ব:
মোহর প্রদান : স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে সন্তুষ্টচিত্তে তার মোহর পরিশোধ করে দেওয়া। (সুরা আননিসা-৪)। মহানবী (সা.) বলেন, ‘অবশ্য পূরণীয় শর্ত হচ্ছে, যার বিনিময়ে তোমরা স্ত্রীর যৌনাঙ্গকে নিজের জন্য হালাল মনে করো।’ অর্থাৎ মোহর।
ভরণ-পোষণ : মহানবী (সা.) বলেন, ‘তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা তোমাদের দায়িত্ব।’ হাকীম বিন মু‘আবিয়া (র.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করি, হে রাসুলুল্লাহ! স্বামীদের ওপর স্ত্রীদের কী হক? তিনি (সা.) বলেন, ‘সে যা খাবে তাকেও (স্ত্রী) তা খাওয়াবে, আর সে যা পরিধান করবে তাকেও তা পরিধান করাবে। আর তার (স্ত্রীর) মুখমণ্ডলে প্রহার করবে না।
সদ্ব্যবহার : মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের সঙ্গে সৎভাবে জীবনযাপন করবে।’ (সুরা আননিসা-১৯)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট সর্বোত্তম।
স্ত্রীর দায়িত্ব:
স্বামীর আনুগত্য করা : মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মহিলা যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজানের রোজা রাখে, নিজের সতীত্বকে রক্ষা করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, তাহলে তাকে (কিয়ামতের দিন) বলা হবে, জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করো।’ তবে স্বামী যদি স্ত্রীকে কোনো পাপের কাজে নির্দেশ প্রদান করে তাহলে স্ত্রী সে নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করবে; কখনো মানবে না।
স্বামীর আমানত রক্ষা করা : স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজেকে সব অশ্লীলতা ও অপকর্ম থেকে হিফাজত করা এবং স্বামীর অর্থ-সম্পদের আমানত রক্ষা করা স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সাধ্বী স্ত্রীরা হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হিফাজতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে তার হিফাযত করে।’ (সুরা আননিসা-৩৪)।
স্বামীর যৌন দাবি পূরণ : মহানী (সা.) বলেন, ‘স্বামী যখন স্ত্রীকে শয্যা গ্রহণের আহ্বান করে তখন সে যদি তাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে তাহলে সকাল হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতাগণ তার প্রতি লানত করতে থাকেন।’
মা-বাবার দায়িত্ব:
সন্তানের লালন-পালন : মা-বাবা সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করে তোলে। সে কারণে ইসলাম পরিবারের বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য মা-বাবার প্রতি সন্তানের কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। বাবা-মার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, তাদেরকে সম্মান করা এবং তাদের আনুগত্য করা সন্তানের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে ও মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ্’ বল না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো।’ (সুরা বনী ইসরাইল -২৩)। তবে মা-বাবা যদি অন্যায় কাজের আদেশ করে তাহলে সেক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমার মা-বাবা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করতে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পৃথিবীতে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে বসবাস করবে।’ (সুরা লুকমান-১৫)।
আকীকা করা ও সুন্দর-অর্থপূর্ণ নাম রাখা : সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে আকীকা করা ও শিশুর একটি সুন্দর ও অর্থবোধক নাম রাখা মা-বাবার অন্যতম কর্তব্য। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক শিশু আকীকার সঙ্গে আবদ্ধ থাকে। জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু জবেহ করা হবে, তার মাথা কামানো হবে এবং তার নাম রাখা হবে।’
সন্তানদের মাঝে সমতা বিধান : ছেলে-মেয়ে উভয়ই মহান আল্লাহর অপার করুণার নিদর্শন। সুতরাং তাদের উভয়ের মাঝে সমতা বিধান ও তাদের প্রতি সুবিচার করা অবশ্য কর্তব্য। নু‘মান বিন বাশীর (রা.)-কে তার বাবা একটি দাস দান করার কথা মহানবীর (সা.)-এর কাছে এসে ব্যক্ত করলে তিনি তাকে বললেন, তোমার অন্য সন্তানদেরকেও কি অনুরূপ দান করেছ। তিনি বললেন, না। তখন মহানবী (সা.) বললেন, আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমার সন্তানদের মাঝে সমতা বিধান করো। একথা শোনে নু‘মানের বাবা তাকে দেওয়া দান ফেরত নেন।
সন্তানদের চরিত্রবান করে গড়ে তোলা : মহানবী (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক শিশু ইসলামী স্বভাবের ওপর জন্মগগ্রহণ করে। অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান অথবা মূর্তিপূজকে পরিণত করে।’ মু‘আয (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) অসিয়ত করলেন, ‘তুমি তোমার উপার্জিত সম্পদ তোমার পরিবারের ওপর সামর্থ্য অনুসারে ব্যয় করো, পরিবার-পরিজনকে শিষ্টাচার শিক্ষাদানের ব্যাপারে শাসন থেকে বিরত থেক না এবং আল্লাহতায়ালার ব্যাপারে পরিবারের লোকজনকে ভীতি প্রদর্শন করো।’ এ হাদিস দুটি থেকে বোঝা যায় যে, সন্তানকে আদর্শবান-চরিত্রবান ও ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সন্তানদের ভালোবাসা : সন্তানরা বাবা-মার নয়নের মণি। তাদের ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতার বাহুডোরে আগলে রাখা মা-বাবার কর্তব্য। হযরত আয়িশা (রা.) বলেন, একদা এক বেদুঈন রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ‘তোমরা কি শিশুদেরকে চুম্বন করো? আমরা তো শিশুদের চুম্বন করি না। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘যদি আল্লাহতায়ালা তোমার অন্তর থেকে স্নেহ-মমতা দূর করে দেন, তাহলে আমি কি তাতে বাধা দিতে সক্ষম হব?’
সন্তানদের জন্য দোয়া করা : বাবা-মার দোয়া সন্তানের জন্য খুবই ফলপ্রসূ। সেজন্য বাবা-মা তাদের সন্তানের ইহকালীন সুখ-সমৃদ্ধি ও পরকালীন মুক্তির জন্য দোয়া করবেন কায়মনবাক্যে হূদয় খুলে। কোরআনে বর্ণিত আছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করো যারা হবে আমাদের জন্য নয়ন প্রীতি কর এবং আমাদের কে করো মুত্তাকীদের জন্য অনুসরণযোগ্য।’ (সুরা আল ফুরকান-৭৪)।
Leave a Reply