আবু সাইদ : জুমার দিন। মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। ইসলামের দৃষ্টিতে পবিত্র জুমা ও জুমাবারের রাত-দিন অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। জুমার দিনের সওয়াব ও মর্যাদা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মতো। এ দিন ইসলামী ইতিহাসে বড় বড় ও মহৎ কিছু ঘটনা ঘটেছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে জুমা’র দিনের অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণিত হয়েছে।
জুমার দিন ও জুমার নামাজের গুরুত্ব স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা কোরআনে তুলে ধরেছেন। পবিত্র কোরআনের ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ছুটে যাও এবং বেচা-কেনা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম, যদি তোমরা বুঝ। অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো ও আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা জুমা: আয়াত ৯-১০)।
হাদিসে জুমার দিন:
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওজু করল, অতঃপর জুমা পড়তে এলো এবং মনোযোগ দিয়ে নীরব থেকে খুতবাহ শুনল, সে ব্যক্তির এই জুমা ও (আগামী) জুমার মধ্যেকার এবং অতিরিক্ত আরো তিন দিনের (ছোট) পাপগুলো মাফ করে দেয়া হবে। (মুসলিম, হাদিস নং: ৮৫৭)
জুমার নামাজের বিধান:
শুক্রবার জুমার নামাজকে ফরজ করা হয়েছে। জুমার দুই রাকাত ফরজ নামাজ ও ইমামের খুতবাকে জোহরের চার রাকাত ফরজ নামাজের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। হজরত তারেক ইবনে শিহাব (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালেগ বাচ্চা ও অসুস্থ ব্যক্তি এই চার প্রকার মানুষ ছাড়া সকল মুসলমানের ওপর জুমার নামাজ জামাতে আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য (ফরজ)। (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর: ১০৬৭; মুসতাদরেকে হাকেম, হাদিস নম্বর : ১০৬২; আস্-সুনানুল কাবির, হাদিস নম্বর: ৫৫৮৭)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া জুমার নামাজ বর্জন করবে, তার নাম মুনাফিক হিসেবে এমন দফতরে লিপিবদ্ধ হবে, যা মুছে ফেলা হবে না এবং পরিবর্তনও করা যাবে না।’ (তাফসিরে মাজহারি, খণ্ড: ৯, পৃষ্ঠা: ২৮৩)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এ মর্মে হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, যেসব লোক জুমার নামাজ থেকে দূরে থাকে (পড়ে না), তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছা হয় যে আমি কাউকে নামাজ পড়ানোর আদেশ করি, সে মানুষকে নামাজ পড়াক। অতঃপর যে সব লোক জুমার নামাজ পড়ে না, আমি তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিই। (মুসলিম, হাদিস নম্বর: ৬৫২; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নম্বর: ৩৮১৬; মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস নম্বর: ৫৫৩৯; আসু-সুনানুল কুবরা, হাদিস নম্বর: ৪৯৩৫)
জুমার সময়ে নিষিদ্ধ কাজ:
জুমার দিনে মূলত আজানের পর থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়টিতে কিছু ফরজ বিধান রয়েছে। এ সময়টিতে কিছু বিধান মেনে চলতে হবে। শরীয়ত বহির্ভূত কোনো কাজ করা যাবে না। যেমন আজান হয়ে যাওয়ার পরও ব্যবসা বা অনর্থক কাজে ব্যস্ত থাকা। উপস্থিত মুসল্লিদের জন্য খুতবা শোনা ওয়াজিব। তাই খুতবা চলাকালে নিরর্থক কাজে লিপ্ত থাকা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
আরো পড়ুন: জুমার নামাজ না পড়লে যেসব শাস্তি অনিবার্য হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিন খুতবা প্রদানের সময় যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে বলো, ‘চুপ করো’ তখন তুমি অনর্থক কথাই বললে।’ (সহিহ বোখারি: ১/১২৮)
বর্ণিত হাদিসের মাধ্যমে সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণ হয়, খুতবার সময় নিশ্চুপ হয়ে খুতবা শোনা ওয়াজিব এবং কথাবার্তা বলা হারাম।
ফিকাহ শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ফাতাওয়ায়ে শামিতে একটি মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে যে, যেসব কর্ম নামাজের মধ্যে হারাম, তা খুতবা চলাকালীন সময়েও হারাম। যেমন: কথাবার্তা বলা, পানাহার করা ইত্যাদি। (ফাতাওয়ায়ে শামি: ৩/৩৫)
জুমার দিনের বিশেষ আমল:
জুমার দিনের সীমাহীন ফজিলত ও সওয়াব রয়েছে। নবী (সা.) বিভিন্ন হাদিসে এসব ফজিলতের কথা তুলে ধরেছেন। বোখারি শরিফের হাদিসে রয়েছে রাসূল (সা.) বলেছেন, কোনো পুরুষ যখন জুমার দিন গোসল করে, সাধ্যমতো পবিত্রতা অর্জন করে, তেল ব্যবহার করে বা ঘরে যে সুগন্ধি আছে তা ব্যবহার করে, তারপর (জুমার জন্য) বের হয় এবং (বসার জন্য) দুই জনকে আলাদা করে না, এরপর সাধ্যমত নামাজ পড়ে এবং ইমাম যখন কথা বলে তখন চুপ থাকে, তাহলে অন্য জুমা পর্যন্ত তার (গুনাহ) মাফ করা হয়।
হাদিসের ভিত্তিতে ফেকাহবিদরা এসব আমলকে নির্দিষ্ট করেছেন। যেমন, ১. জুমার দিন গোসল করা। যাদের ওপর জুমা ফরজ তাদের জন্য এ দিনে গোসল করাকে রাসূল (সা) ওয়াজিব করেছেন। ২. পরিচ্ছন্নতার অংশহিসেবে সেদিন নখ ও চুলকাটা একটি ভালো কাজ। ৩. জুমার সালাতের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা। (বুখারি) ৪. মিস্ওয়াক করা। (ইবনে মাজাহ) ৫. গায়ে তেল ব্যবহার করা। (বুখারি) ৬. উত্তম পোশাক পরিধান করে জুমা আদায় করা। (ইবনে মাজাহ) ৭. মুসল্লিদের ইমামের দিকে মুখ করে বসা। (তিরমিযি) ৮. পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া। (আবু দাউদ) ৯. জুমার দিন ও রাতে বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ। (আবু দাউদ: ১০৪৭) ১০. এ দিন বেশি বেশি দোয়া করা। (বুখারি) ১১. মুসুল্লীদের ফাঁক করে মসজিদে সামনের দিকে এগিয়ে না যাওয়া। (বুখারি) ১২. জুমা’র দিন সূরা কাহাফ পড়া। পাঠকারীর জন্য আল্লাহ তায়ালা দুই জুমা’র মধ্যবর্তী সময়কে আলোকিত করে দেন।
জুমার দিনে দোয়া কবুলে সময়:
জুমাবারের ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এই দিনে এমন একটা সময় আছে, যখন মুমিন বান্দা কোনো দোয়া করলে মহান আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিনে একটা এমন সময় আছে, যে সময়ে কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে তা দান করবেন। (সহীহ মুসলিম: ৮৫২, মুসনাদে আহমাদ: ৭১৫১, আস্-সুনানুল কুবরা : ১০২৩৪) জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সে মহামূল্যবান সময় কোনটা? এ সম্পর্কে ৪৫টা মতামত পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হলো, আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দোয়া কবুলের সময়।
হজরত আনাস (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিনের কাঙ্ক্ষিত সময়টা হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। (তিরমিজি, হাদিস নম্বর: ৪৮৯; মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস নম্বর : ৫৪৬০)
জুমার দিন বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করা:
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা জুমার দিনে বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করো। কারণ জিবরাঈল (আ.) এইমাত্র আল্লাহ তায়ালার বাণী নিয়ে উপস্থিত হলেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘পৃথিবীতে যখন কোনো মুসলমান আপনার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে আমি তার ওপর দশবার রহমত নাজিল করি এবং আমার সব ফেরেশতা তার জন্য দশবার ইস্তেগফার করে।’ (তারগিব: ৩/২৯৯)
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা সকল মুসলিম উম্মাহকে কোরআন হাদিসের আলোকে সাপ্তাহিক ঈদ জুমার নামাজ ও দিনের আমলগুলো করার তাওফিক দান করুন।
Leave a Reply