আব্দুল হামিদ নাছার, লন্ডন :প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিবের বাংলায় কেউ ঠিকানাহীন থাকবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও বাসস্থান-দেশের মানুষের এসব মৌলিক চাহিদা পুরণ করতে বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছে আমাদের সরকার। আমরা এসব ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে সফলতা অর্জন করেছি। মানুষের জীবন আমাদের কাছে বড়। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ইতোমধ্যে আমরা চার লক্ষ গৃহহীনকে গৃহ প্রদান করেছি, আরও এক লক্ষ তৈরী হচ্ছে।
রবিবার (৭ নভেম্বর) স্থানীয় সময় বিকেলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবন সংলগ্ন কুইন এলিজাবেথ সেন্টারে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন প্রধানমন্ত্রী।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুকের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশের শুরুতে পবীত্র কোরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠ করা হয়। তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও কোন বক্তব্য রাখেননি।
সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ্ব জালাল উদ্দিন, অধ্যাপক আবুল হাশেম, নঈমুদ্দিন রিয়াজ, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, আব্দুল আহাদ চৌধুরী, মেহের নিগার চৌধুরী, ব্যারিষ্টার এনামুল হক ও যুক্তরাজ্য যুবলীগ সভাপতি ফখরুল ইসলাম মধু।
ভার্চুয়ালী সংযুক্ত হয়ে সমাবেশে দীর্ঘ ৪১ মিনিট বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাস্থ্য সতর্কতার কারণে ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও নেতাকর্মীদের সাথে স্বশরীরে মিলিত হতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের সাথে বঙ্গবন্ধুসহ আমাদের পরিবারের আত্মিক সম্পর্কের ঋণ এবার ভার্চুয়ালী স্বীকার করতে হচ্ছে আমাকে, বিষয়টি আমার জন্য সুখকর নয়। এই বৈরী সময় অতিক্রম করে ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতে আমরা আবারও মিলিত হবো।
এসময় তিনি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দুঃসময়ে প্রবাসীদের সহযোগীতার কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে ব্রিটিশ মূলধারায় বাঙালি কমিউনিটির আজকের সমৃদ্ধ অবস্থানে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের চারজন ও স্কটিশ পার্লামেন্টের একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এমপির নাম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু দেশ নয়, আজ সারা বিশ্বেই বাঙালিরা নিজেদের জন্য সম্মানজনক অবস্থান তৈরী করছে।
দেশের বর্তমান আর্থ সামাজিক উন্নয়নের সংক্ষিপ্ত বর্ণণা দিতে গেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশের লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্থে বাংলাদেশ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন আজ বিশ্ববাসীর কাছে আশ্চর্য লাগছে। আসলে এটি আশ্চর্যের কিছু নয়। স্বপ্ন দেখাতে পারলে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাখে বাঙালী জাতি, এটি আমাদের ইতিহাসই বলে। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখিয়ে সাথে সাথে এটিও বলেছিলেন, ‘বাঙালিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না’। জাতির জনকের সেই স্বপ্নেরই ধারাবাহিক বাস্তবায়ন আজকের এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রা।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই করোনাকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মাথাপিছু আয় যেখানে কমেছে, সেখানে আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে উঠেছে ২ হাজার ৫শ ৫৩ ডলারে। কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব সাধন করেছে আমাদের কৃষকরা। আমাদের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে আবিস্কার করেছে খরা, লবনাক্ততাসহ প্রকৃতি মানানসই ধান বীজ। বিএনপি আমলের ৯০ টাকা দামের সার ভর্তুকি দিয়ে আমাদের সরকার কৃষকদের দিচ্ছে ১৬ টাকায়। সারের জন্য এখন কোন কৃষক বিএনপি আমলের মতো গুলি খেয়ে মরে না।
ডিজিটেলাইজেশনে বাংলাদেশ আজ বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সব প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চলছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ভূমি ব্যবস্থাপনাও ডিজিটাল হচ্ছে দ্রুতই।
তিনি বলেন, দেশের ৯৯.৯% এলাকা এখন বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। আজকের বাংলাদেশ আর ভিক্ষে করে চলে না, আজ বাংলাদেশ নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল অংকের উন্নয়ন বাজেটের ৯০%ই সংগ্রহ হয় আমাদের নিজেদের থেকে।
তিনি বলেন, মহামারি করোনায় ধাক্কা খেলেও আমরা শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছি। এই সময় প্রণোদনাসহ নগদ সাহায্য পৌছে দিয়েছি মানুষের ঘরে ঘরে। করোনা টিকা দিয়েছি সবাইকে, আরও ২৫ কোটি করোনা টিকা রেখেছি তৈরী করে।
শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের বর্ণণা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন দেশের প্রতিটি উপজেলায় সরকারী স্কুল কলেজ, প্রতিটি বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি সিলেটেও যে একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে তা জানান দেন যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের।
শেখ হাসিনা দেশে একক অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরীর কথা জানিয়ে বলেন, একেকটি অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট দেশের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এশিয়া প্যাসিফিক অর্থনীতির উদিয়মান শক্তি বিনিয়োগবান্ধব বাংলাদেশে নিজেদের ব্যবসা বানিজ্য সম্প্রসারিত করে ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই নিশ্য়তা আমি দিতে পারি। তিনি জানান, দেশে প্রায় ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২৮টি হাইটেক পার্ক বিদেশি ও দেশীয় বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, জনসংখ্যার সুফল এবং বিনিয়োগকারীরা যাতে প্রতিযোগিতামূলক দামে দক্ষ মানবসম্পদ পায়, তা নিশ্চিতের ওপর আমাদের দৃষ্টি রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত দশকব্যাপী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বাংলাদেশকে বিশ্ব বানিজ্যের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র হিসেবে নতুন পরিচয় এনে দিয়েছে। এই কেন্দ্রে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা যেমন লাভবান হবেন, বাংলাদেশও তেমনি পাবে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সহযোগী শক্তি। ভিশন-২০৪১ এর কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার সংগ্রামে বাংলাদেশ দ্রুত দৌড়াচ্ছে উজ্জ্বল আগামীর পথে। এই দৌড়ে শুধু বাংলাদেশের জনগন নয়, ব্রিটেনসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে আমরা সহযোগী হিসেবে চাই।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অনাবাসী বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের কারী ইন্ডাষ্ট্রি ব্রিটিশ জাতীর খাদ্যাভাস বদলে যে ভূমিকা রেখেছে, তাতো ইতিহাসের অংশ। এই কারী পরিপূর্ণ সুস্বাদু করে ব্রিটিশদের পাতে তুলে দিতে যেসব উপাদান দরকার তা আজকের দিনে খুব সহজেই বাংলাদেশে তৈরী করা যায়। বাংলাদেশের মানুষ এখন শুধু সিজনে নয়, প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে সারা বছরই শাক সব্জি, মাছ এগুলোর স্বাদ গ্রহন করছে। তিনি বলেন, ব্রিটিশ জাতির খাদ্যাভাস বদলে দেয়া আপনার কারীর আনুসাঙ্গিক উপাদান আপনি আপনার শিকড়ভূমিতে তৈরী করবেন, বাংলাদেশের জনগন নিশ্চয়ই এটি আশা করতে পারে। বাংলাদেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুলার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে, আপনারা ব্রিটিশ ব্যাবসায়ীদের পার্টনার করে বাংলাদেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুলুন। সব ধরনের সুযোগ সুবিধা আপনারা পাবেন। এতে কোন অসুবিধা হলে আমিতো আছিই।
শেখ হাসিনা এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেশের সাধারণ মানুষের অবদানের কথা স্মরণ করে, বিগত দিনে উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ করতে বিএনপি-জামাতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কথাও দুঃখের সাথে উল্লেখ করেন দলের নেতাকর্মীদের কাছে। তিনি বলেন, মানুষের সুখ-দুঃখে সম্পৃক্ত না থাকলে কোন রাজনৈতিক দলই ঠিকতে পারে না, বিএনপির আজকের অবস্থা তারই প্রমাণ। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে দণ্ডিত অপরাধী আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা ও একুশে আগষ্টের গ্রেনেড হামলার দণ্ডিত অপরাধী তারেক বা এতিমের টাকা মেরে খাওয়া খালেদা জিয়া যে দলের নেতৃত্বে থাকে সেই দলের প্রতি মানুষ আস্থা রাখবে কীভাবে?
Leave a Reply