শিহাব আহমেদ : ষড়ঋতুর নাগরদোলায় এখন গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে এখন চলছে ভরা বর্ষা। প্রচন্ড দাবদাহের মধ্যে মুষলধারায় হয়ে যাচ্ছে কয়েক পশলা বৃষ্টি। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের এই সময়ে দেশি ফ্যাশন হাউসগুলোতে চলছে বর্ষাদিনে পোশাকের সমাহার। নগর জীবনে প্রকৃতির সৌন্দর্য তেমন চোখে না পড়লেও প্রকৃতির পরিবর্তন ফুটিয়ে তোলার কাজ বিগত দুই দশক ধরে নিষ্ঠার সাথে করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠিত এসব ফ্যাশন হাউস। গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমের পরপরই বর্ষার আগমন ঘটেছে তার নিজস্ব বর্ণ ও গন্ধ নিয়ে। প্রকৃতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আকাশের কালো ঘন মেঘ আর মুষলধারে ঝুমঝুম বৃষ্টি। আর বর্ষার এ সময়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা একটু হলেও বদলে যায়। শহুরে নাগরিক জীবনে এই বর্ষায় পথচারীকে শহুরে রাস্তায় চলার সময় কাদা, জল ইত্যাদি নানা ঝামেলা পেরিয়ে চলতে দেখা যায়। যার কারণে একজন সচেতন নাগরিককে পোশাক-পরিচ্ছদ নির্বাচন করতে হয় একটু চিন্তাভাবনা করে। তাই এ ঋতুতে পোশাকের রঙ ও ডিজাইনেও থাকে ভিন্নতা। যান্ত্রিকতায় মোড়ানো এই শহরে এক পশলা বৃষ্টি যেমন বিড়ম্বিত করে, তেমনি এনে দেয় স্বস্তি। গ্রামগঞ্জে বর্ষা তার রূপ যেমন বিলিয়ে দেয় নদীনালা, খালবিল, বনজঙ্গলে; তেমনি ফ্যাশন হাউসগুলোর টি-শার্ট, ফতুয়া, পাঞ্জাবি আর শাড়িতে ফুটিয়ে তোলা হয় শিল্পিতভাবে। ঠিক তেলরঙ, জলরঙ্গে মাখা বর্ষার ছবির মতো ফুটে ওঠে আমাদের প্রকৃতি।
বৃষ্টিদিনের নীলাভ খুনসুঁটি রঙের বর্ণিলতায় নীলের জনপ্রিয়তাটা আকাশচুম্বী। আকাশের চাঁদোয়া নীল বলেই হয়তো বিশালতার উপমায় ঠাঁই হয়েছে নীলের। এ নীল শুধু জাগতিক বাস্তবতাকেই নয়, ক্ষণে ছুঁয়ে যায় স্বপ্নিল পরাবাস্তবকেও। রঙধনু বুকে নিয়ে নীল আকাশ যেমন ধরিত্রীতে রঙের বর্ষণ ঘটায়, তেমনি আমাদের মানব জীবনেও নীলের ছোঁয়া বয়ে আনে স্নিগ্ধ সুখের পরশ। প্রকৃতির পরম উপহার ছয়টি ঋতুই আসে রঙের ভিন্নতা নিয়ে। আর এর মাঝে বর্ষার কাছেই খুঁজে পাওয়া যায় প্রিয় নীলের সান্নিধ্য। ঝমঝম নির্লিপ্ত বর্ষাঝরা দিনে একফালি নীল বুঝি না হলেই নয়। বৃষ্টি ধোয়া আকাশ চাঁদোয়ার যখন হেসে ওঠে হৃদয়গ্রাহী নীলে নিপুণ খুনসুঁটি, তখন যাপিত জীবনে নেমে আসে স্বস্তির আঁচ।
বর্ষার স্নিগ্ধতা নগর জীবনকে যতটা ছুঁয়ে যায়, তার থেকে অনেক বেশি ছুঁয়ে যায় গ্রামবাংলাকে। সেখানে বর্ষা মানে খালবিলে নতুন পানি। সবুজ জলের সন্তরণে ভেসে উঠে নীল আকাশের ছবি। আর শহর জীবনে বর্ষার বর্ষণ হয়তো ব্যস্ত জীবনে কিছুটা ছন্দপতন আনে। কিন্তু ফ্যাশন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ভাসে বর্ষার স্নাত নীল রঙের ভেলা। নীল শুধু পোশাকে নয়, ভরা বর্ষায় নীল ছুঁয়ে যায় সবকিছু। নীলাম্বরী বর্ষা আকাশে মেঘ আর বাতাসে বৃষ্টির ঘনঘটা। সব মিলিয়ে প্রকৃতিতে পরিকল্পিত আষাঢ়ে আয়োজন। নীল রঙের আঁধারে সে আয়োজন হোক আরেকটু মধুময়। প্রাকৃতিক উৎসবের অনন্য নাম বর্ষা। বর্ষার স্নিগ্ধতা নগরজীবনকে আপন করে ছুঁয়ে যায়। ছুঁয়ে যায় গ্রামবাংলার প্রতিটি নদনদী, ঘরবাড়ি আর এলোমেলো পথঘাট। বর্ষা এলেই নীলের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায় ফ্যাশন হাউসগুলোতে। দেশের নামকরা সব ফ্যাশনহাউসে সব নীল পোশাকের ভাঁজ খুলতে শুরু করে। আর সেই সুবাদে বর্ষাজুড়ে ফ্যাশনে নীলের প্রভাবটা লক্ষণীয়। সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ যুগের বাঙালিরা এখন রঙ আর ঋতু সচেতন। আর তাই বর্ষার পোশাক মানেই নীল গ্রহণ শাড়ির বদলে নীল কামিজও মানাবে দারুণ। বর্ষায় সাধারণত সুতির আধিক্যতাই একটু বেশি থাকে। তবে এসময় মোলায়েম রেশমি, ধুপিয়ান, মসলিন এসব কাপড়ও ব্যবহার করতে পারেন। যে কাপড়ই গায়ে জড়ান না কেন, মনে রাখবেন আমাদের দেশে বর্ষা কিন্তু খুব ঠাণ্ডা পরিবেশ বয়ে আনে না, বরং অনেক সময় আবহাওয়াটা একটু ঘোলাটে গরমের জন্ম দেয়। আর তাই পোশাকে কোনো ভারী কাপড় আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিতে পারে বলে, নীল কামিজে একটু স্নিগ্ধ ভাব খুঁজে বের করুন। সঙ্গে গয়নাগাটি খুব ভারী ব্যবহার না করাই ভালো। আর জুতা এমনভাবে নির্বাচন করুন যেন, কর্দমাক্ত পথ মাড়াতে আপনাকে জুতো জোড়া বগলদাবা করতে না হয়।
তরুণের বর্ষা :
তরুণরা এই বর্ষায় জিন্সের সঙ্গে পরতে পারেন ফতুয়া। দেখবেন আপনার প্রিয় নীল জিন্সটি নিঃসন্দেহে এই বর্ষায় হয়ে উঠবে আপনার প্রিয় পোশাক। বর্ষায় নীল জিন্সের সঙ্গে নীলের কোনো ভিন্ন শ্যাডের ফতুয়া ব্যবহার করুন। সেই সঙ্গে পায়ে কনভাস কিংবা যে কোনো ক্যাজুয়াল স্নিকার্স মানিয়ে যাবে দারুণ। বর্ষায় ছেলেদের জন্য বর্ষার ফ্যাশনের নীল উঠে আসে শার্ট, পাঞ্জাবি কিংবা ফতুয়ায়। বর্ষায় শার্টে শুধুই নীল রাখতে পারেন। কিংবা কোনো ট্রাইবাল টেক্সচারের নীল শার্ট আপনার স্মার্টনেসের পাশাপাশি আপনার রুচিরও বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে। বর্ষায় এমন কিছু ফতুয়া ব্যবহার করুন যেগুলো ভাপসা গরমের হাত থেকে আপনাকে রক্ষা করবে আর সেই সঙ্গে নীলের ছোঁয়া এনে দেবে প্রশান্তি। শার্ট ফতুয়ার বাইরে ছেলেরা বর্ষায় নীল শ্যাডের টি-শার্ট ব্যবহার করতে পারেন। তবে একটু ভিন্ন লুক আনতে ক্যাজুয়াল স্নিকার্সের সঙ্গে সাদা প্যান্ট আর ওপরে কোনো নীল শার্ট কিংবা টি-শার্ট পরুন, দেখবেন এই বর্ষায় সবার নজর আটকে যাবে ঠিক আপনার দিকেই। জীবনধারায় বর্ষা নীল শুধুই পোশাক আর ফ্যাশনে নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও বর্ষা আসে যেন নীল বার্তা নিয়ে। প্রিয় মানুষটির কাছে লেখা চিঠিটা যখন সযতনে ঠাঁই নেয় নীল খামে তেমনি প্রেয়সীর নীল আঁচল কিংবা জানালাজুড়ে নীল পর্দার এক দৌড় মনে করিয়ে দেয় বাইরের ভেজা বর্ষার বর্ষায় সাজ। জীবনের প্রতিটি পরত ভেসে যায় বর্ষার নীলে। ঘরের কোনায় ছোট্ট কুশন কাভার থেকে শুরু করে বিছানা চাদর, পর্দা এসবেও নীলের ব্যবহার বর্ষাকে আরও বেশি উপভোগ্য করে তুলবে। তাই এমন করে সাজিয়ে তুলুন আপনার অন্দরকে। বর্ষায় অন্দর সাজাতে এমন কিছু উপাদান ব্যবহার করুন যেগুলো আপনার পুরো পরিবেশটাকে অনেক বেশি নীলাভ করে তুলবে। যদি ঘর ছোট হয় তাহলে এক রঙা নীল পর্দা ব্যবহার করুন। আর বড় ঘরের জন্য নীলের কোনো ছাপাও মানিয়ে যাবে বেশ। কুশন কাভারগুলোতে নীল ভাবনাটা রাখতে চেষ্টা করুন। এমনকি আপনার গাড়িতেও এমন ২ থেকে ৩টা নীল কুশন থাকলে দারুণ মানাবে। বিছানার চাদরে নীল অথবা নীল সাদা মিশেল রাখুন। আর খাবার টেবিলে রাখুন নীল রঙা ন্যাপকিন। দেখবেন এই বর্ষায় বর্ষা আপনাকে আলিঙ্গন করবে নীল চাদরে জড়িয়ে। সাধারণত বৃষ্টির সময় বা মেঘলা মেঘলা আবহাওয়ায় এমন পোশাকই নির্বাচন করা উচিত, যা বৃষ্টিতে ভিজলে দ্রুত শুকিয়ে যায়। আবার হুট করে রোদ উঠলেও অস্বস্তি তৈরি করে না। এক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃত্রিম তন্তুজাত কাপড়ই আপনাকে সুরক্ষিত রাখবে। তবে কৃত্রিম তন্তুজাত কাপড়ে যাদের এলার্জি আছে কিংবা যারা এ ধরনের কাপড় পড়ে স্বস্তি পান না তারা জর্জেট, সিল্ক কিংবা দেশি ভয়েল ধরনের কাপড়ের পোশাক পরতে পারেন।
এছাড়া আমাদের দেশের রাজশাহী সিল্ক বা হাফসিল্ক, সুতি জর্জেট বা বেক্সি জর্জেটের তৈরি পোশাকগুলোও বর্ষার দিনে আপনাকে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা দেবে। ফিটিং পোশাক আদর্শ বেশি ঢিলেঢালা পোশাক শুকাতে সময় লাগে। বললেন ফ্যাশন হাউস তারা মার্কার ডিজাইনার অভিজিৎ চৌধুরী। তিনি আরো বলেন, সালোয়ার-কামিজের পাশাপাশি টিনএজার তরুণীদের পছন্দ টপস বা কুর্তা। সঙ্গে জিন্স বা চুড়িদার পায়জামার সঙ্গে ছোট ওড়না। বর্ষা ও রোদ একসঙ্গে সামলাতে থ্রি-কোয়ার্টার হাতা বেশ কাজের। স্লিভলেস হাতাও পরতে পারেন। রঙ প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে বর্ষায় কাপড়ের রঙ নির্বাচনের বিষয়ে ডিজাইনার বিপ্লব সাহা জানালেন, ভিজলে রঙ উঠে যায় এমন পোশাক একেবারেই নয়। কাপড়ের রঙ নির্বাচনে বর্ষা প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নীল, সবুজ, কমলা, আকাশি, অফ হোয়াইট, গোলাপি এবং উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরুন। যাকে বলে ফ্যাশন বর্ষা বর্ষার আগমনে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাশন হাউসগুলো বদলে নিয়েছে তাদের পোশাকের গড়ন, ধরন ও রঙ। পোশাকগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বর্ষার বিভিন্ন দৃশ্য। কদম ফুল, বৃষ্টি, গ্রামের মেঠোপথ, মেঘ, ফসলের ক্ষেত এসব ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পোশাকে। ফ্যাশন হাউসগুলো পোশাকে প্রাধান্য দিয়েছে হালকা মোটিফের কাজ অধিকাংশ পোশাকে করা হয়েছে। হাতের কাজ, সঙ্গে স্ক্রিন প্রিন্ট অথবা ব্লক। সঙ্গে এপ্লিক ও হালকা মেশিন এমব্রয়ডারি রয়েছে। শাড়ির ক্ষেত্রেও বর্ষার প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার কবিতা এবং স্ক্রিন প্রিন্টের সঙ্গে হালকা হাতের কাজও রয়েছে।
কোথায় পাবেন :
দেশের নাম করা প্রতিটি ফ্যাশন হাউসে একটু খুঁজলেই নীল পোশাকের সন্ধান মিলে যাবে। তবে রাজধানীর নিউমার্কেট, বসুন্ধরা সিটি, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, মৌচাক মার্কেট, কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি, রাইফেলস স্কয়ারসহ বেশকিছু শপিংমল থেকে আপনি একটু খুঁজলেই পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দের পোশাক আর ঘর সাজানোর উপকরণগুলো। ফ্যাশন হাউসগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘রঙ’, ‘দেশীদশ’, ‘কারখানা’, ‘দর্জিবাড়ি’, ‘ব্যাঙ’, ‘স্টাইল পার্ক’ ‘মুসলিম কালেকশন’, আর বুটিক হাউসগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘এক্সেল’, ‘লোকজ’, ‘বালুচর’, ‘উত্তরাঙ্গন’।
চুলের যত্ন :
বৃষ্টি ভিজে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় চুলের। তাই যে কোনো ফ্যাশন সচেতন নারীরাই চুলের বাড়তি যত নিয়ে থাকেন। কেননা এই সময় চুল শুষ্ক হয়ে যায়। চুল ওঠার প্রবণতাও বেড়ে যায়। প্রতি মাসে একবার করে চুল ট্রিম করিয়ে নিন। এতে চুল কম উঠবে। চুলে হট অয়েল ম্যাসাজ করুন। তাতে চুল রুক্ষ হবে না। চুলে প্রোটিন সরবরাহ হবে। আপনার চুলে বর্ষায় একটু উজ্জ্বল রঙ করতে পরেন। পুরো চুলে না করে এক একটা স্ট্রিপ হাইলাইট করে নিন। তাতে আপনাকে বেশ ফুরফুরে লাগবে।
মুখের মেকআপ :
বর্ষায় মুখে বেশি চড়া মেকআপ নেয়া উচিত নয়। এই সময় হলকা মেকআপ করুন। বৃষ্টির সময় বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় ঘামও বেশি হয়। তাতে আপনার মেকআপ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মুখে অবশ্যই ওয়াটার প্রুফ মেকআপ ব্যবহার করুন। ম্যাট ফিনিশের মেকআপ বর্ষায় ভালো লাগে।
বর্ষার জুতো :
দামি চামড়ার জুতা না পরাই ভালো। কেননা এই বর্ষায় সবচেয়ে ক্ষতি করে চামড়ার। একের বেশি জুতো অবশ্যই সঙ্গে রাখুন। বর্ষায় প্লাস্টিক বা নন লেদার ম্যাটারিয়েলের জুতো পরুন।
Leave a Reply